নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব: কি প্রত্যাশা করা উচিত?

নানা আলোচনা ও প্রত্যাশার পর, একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। রক্তাক্ত বিপ্লবের ফল হিসেবে গঠিত হতে যাওয়া এই দলটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। দলটি গ্রহণযোগ্য কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার প্রয়াস চালাবে। স্বাভাবিকভাবেই, জনগণ নতুন দলের কাছে নতুন ধরনের রাজনীতি প্রত্যাশা করছে।

যদিও দলটির আত্মপ্রকাশে কিছু বিলম্ব হয়েছে, শেষ পর্যন্ত এ মাসের শেষ দিনেই এটি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করবে। নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে মতবিরোধ ও মতভিন্নতা কর্মীদের মধ্যে থাকতেই পারে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার স্বাভাবিক অংশ। এসব মতভিন্নতাকে অতিক্রম করে দলটির আত্মপ্রকাশই এখন গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি নতুন দলের আগমন সময়োপযোগী ও জরুরি হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ গণবিপ্লবের মুখে পিছু হটেছে, আর তাদের অনুপস্থিতিতে রাজনীতির শূন্যতা পূরণের আশায় নতুন দলটি আত্মপ্রকাশ করছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর একটি নতুন দল গঠিত হয়েছে, আর একটি দল গুরুত্ব হারিয়েছে বা বিলুপ্ত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে কংগ্রেসের একক আধিপত্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, মুসলিম লীগের আবির্ভাব ঘটেছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ) মুসলিম লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের বিপরীতে জাসদ গড়ে উঠলেও তাদের হঠকারী রাজনীতির কারণে স্থায়িত্ব পায়নি। পরবর্তী সময়ে বিএনপি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পিছু হটেছে। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এবার নতুন দল হিসেবে ছাত্রদের উদ্যোগটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

যদিও তারা নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালুর কথা বলছে, বাস্তবিক অর্থে তারা কতটা নতুন পথ বেছে নিতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাদের দল গঠন-পূর্ব কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, তারা পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই অনুসরণ করছে। অনেকে বলছেন, নতুন দলটি মূলত একটি ‘কিংস পার্টি’। বিএনপি নেতারাও এমন অভিযোগ করেছেন, কারণ সরকারের তিনজন উপদেষ্টা ছাত্রদের দলের সঙ্গে যুক্ত।

বিএনপি গঠনের সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকলেও, তখন দেশে কোনো রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল না, কারণ বাকশালের মাধ্যমে সব দল বিলুপ্ত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রদের দলটি একটি সক্রিয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আত্মপ্রকাশ করছে, যা রাষ্ট্রপতি এরশাদের জাতীয় পার্টি গঠনের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে।

ছাত্ররা নতুন বন্দোবস্তের কথা বললেও তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কতটা নতুন, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তারা বিএনপির বিরুদ্ধে অহেতুক বিরোধিতার নীতি নিয়েছে, যা নতুন রাজনীতির জন্য ইতিবাচক নয়। রাজনীতিতে তর্ক-বিতর্ক থাকবেই, তবে তাদের উচিত হবে নিজেদের দলীয় কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের কাছে যাওয়া ও গঠনমূলক রাজনীতি করা।

এখন পর্যন্ত ছাত্রদের দলের আদর্শিক ভিত্তি অস্পষ্ট। মুসলিম লীগ মুসলিম পরিচয়কে, আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে, বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইসলামপন্থীরা ধর্মীয় ভিত্তিতে এবং বামপন্থীরা মার্ক্সবাদী আদর্শে রাজনীতি করছে। কিন্তু ছাত্রদের দল কোন আদর্শে রাজনীতি করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তারা মধ্যপন্থী হতে চাইলেও তাদের রাজনৈতিক আচরণে ডানপন্থার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

একাত্তর প্রসঙ্গে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটি অবস্থান স্পষ্ট করলেও, দলে এমন অনেকে রয়েছেন, যারা ১৯৭১-এর ঘটনা ২০২৪-এর বিপ্লব দিয়ে আড়াল করতে চান। এতে তাদের রাজনৈতিক স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। দলটি আদৌ মধ্যপন্থী থাকবে নাকি ডান বা ইসলামপন্থার দিকে ঝুঁকবে, তা এখনো অনিশ্চিত।

রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে দলটিকে একটি স্পষ্ট আদর্শিক ভিত্তি ও বয়ান তৈরি করতে হবে। জনগণ যদি তা গ্রহণ করে, তাহলে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক শক্তি হতে পারবে। অন্যথায়, জাসদের মতো হঠকারী রাজনীতির কারণে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যাবে। বিএনপিকে একমাত্র প্রতিপক্ষ ভাবার পরিবর্তে তাদের উচিত হবে সতর্কভাবে রাজনৈতিক পথচলা, কারণ রাজনীতির মাঠে নানা জটিল ফাঁদ রয়েছে। সামান্য ভুলেই তারা বড় বিপদে পড়তে পারে।

Leave a comment